অমানুষ
– রাখী চক্রবর্তী
সম্পত্তি, সম্পত্তি করে তুমি পাগল হয়ে যাবে দাদা। এখনও সময় আছে বদলে ফেলো নিজেকে।
– হ্যাঁ ,আমি পাগল হয়ে যাব। আমার টাকা, বাড়ি, জমি সব চাই সব, এখনই চাই।
– বাবার উইলে পরিষ্কার লেখা আছে যতদিন মা বেঁচে থাকবে ততদিন আমরা কিছু পাবো না। মার অবর্তমানে আমরা সব পাবো।
– তুই থাক অপেক্ষাতে। মার ঠিকুজি কুষ্টিতে লেখা আছে দেখিস নি? মার দীর্ঘ আয়ু।একশো বছর বাঁচবে মা। আমি সত্তর বছর বয়স পর্যন্ত ধুধুল চুষবো? কেন? কেন ? বাবা এ রকম উইল করলো।
– ঠিক করেছে বাবা। বাবা হয়তো তোমার কুমতলব বুঝে গেছিলো তাই এই উইল বাবা করে গেছে। খুব ভালো করেছে বাবা। তা না হলে এতদিনে তুমি সব মাকে দিয়ে নিজের নামে লিখিয়ে নিতে। সম্পত্তির পারিমাণ তো আর কম না। টাকা টাকা করে অমানুষ হয়ে গেছো তুমি।
মাঝে মধ্যেই এ বাড়িতে দু’ ভাই জয় বিজয়ের মধ্যে মত বিরোধ, বিবাদ লেগেই থাকে। টাকা পয়সা সম্পত্তি এই নিয়ে। তবে ওদের মা অমরাবতী দেবী দিব্য আছেন।ছেলেদের লড়াই দেখে শুনে চোখ কান বন্ধ রেখে গল্পের বইতে মুখ গুঁজে পড়ে থাকেন দিনরাত। তবে মেয়ের বাড়ি যান মাঝে মধ্যেই। একমাত্র মেয়ে সুলতাকে জমিদার বাড়িতে বিয়ে দিয়ে অমরাবতী দেবী নিশ্চিন্তে আছেন।
বড় ছেলে জয় স্বভাব চরিত্র ভালো না। বেশ্যা পাড়ায় যাতায়াত করে। সুরাপানে আসক্ত। সম্পত্তির লোভ।
বিজয় খুব ভালো ছেলে মাতৃভক্ত, পিতৃভক্ত। এলাকায় যথেষ্ট সুনাম আছে ওর। না, বিয়ে থাওয়া করেনি এখনও দু’ ভাই।
গত একমাসে আগে ঘটনাটা ঘটেছিল। সেদিন জয় অনেক রাতে বেশ্যা পাড়া থেকে বাড়ি ফিরছিল নিজে ড্রাইভ করে। পেছন থেকে একটা ট্রাক ধাক্কা মারে জয়ের গাড়িতে। সেই রাতেই নার্সিং হোমে পুলিশ ভর্তি করলো জয়কে, মরণাপন্ন অবস্থা হয়ে ছিল জয়ের। তারপর ওর জীবন হঠাৎ করে থমকে গেল। নার্সিং হোম থেকে বাড়ি এলো।জয় আর নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে না।বিছানায় শয্যাগত হয়ে আছে একমাস।ডাক্তারবাবু বলেছেন পেশেন্ট যেন উত্তেজিত না হয়। কারণ হার্ট ফেল হওয়ার সম্ভাবনা তীব্র।
সেদিন রবিবার ছিল অমরাবতী দেবীর ড্রাইভার কুনাল খুব সকালে জয়ের কাছে গিয়ে দুঃসংবাদ দিলো, স্যার, আপনার মা আর এ পৃথিবীতে নেই। জয় এই খবর শুনে আনন্দে দিশেহারা হয়ে গেল, ও ভুলে গেল যে ওর পা অসাড়। কোমর পর্যন্ত কোন সাড় নেই। খাট থেকে নামতে গিয়ে পড়ে গেল।মাথা ফেটে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। কেউ জানতেও পারলো না। কারণ ড্রাইভার দুঃসংবাদ দিয়েই চলে গেছিলো। তবে অমরাবতী দেবীর ড্রাইভার কুনাল জয়ের কাছে এসেছিল এক ঘন্টা পর। ততক্ষণে জয়ের জীবন প্রদীপ নিভে গেছিল। জয়ের চোখের মধ্যেই সম্পত্তি টাকা, জমি, বাড়ি সব বন্দী হয়ে গেছে ।
এদিকে বিজয় তিনদিনের জন্য বন্ধুদের সাথে বেড়াতে গেছিল,
বিজয়ের কাছে যখন দু’টো মর্মান্তিক খবর গেল বিজয় তখন পাগলের মতো করতে লাগল। চিৎকার করে বললো, দাদা আমি তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারব না। তুমি আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাও। তোমার সাথে ঝগড়া বিবাদ এতে আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি। মা তোমাকে ছাড়া আমি থাকব কেমন করে।
বিজয় বাড়ি ফিরল আলুথালু অবস্থায়।
জয়ের মৃতদেহ ময়না তদন্ত হল। রিপোর্ট এল অত্যাধিক উত্তেজনা বশতঃ খাট থেকে পড়ে গিয়ে রক্তক্ষরণ হয়ে মারা গেছে জয়। পাথর হয়ে গেল বিজয় দুই দুটো প্রিয় জনের মৃত্যু শোকে ।
সৎকার হল জয়ের মৃতদেহের সাথে অমরাবতী দেবীর। মা ছেলের চিতা জ্বলছে পাশাপাশি।
বিজয় নির্বাক।
সুলতা মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে শ্মশানে। কি থেকে কি হয়ে গেল। মার আয়ু তো বিশাল ছিল তবে কেন এই অনর্থ হলো। ভেবে কুলকিনারা করতে পারছে না। দাদা খারাপ ছিল কিন্তু মৃত্যু কামনা তো করিনি কোনদিন। তবে কেন এমন হল। চিতা নিভে গেল মা ছেলের।
বিজয় বোনের হাত ধরে বলল, আমি আছি তো। চিন্তা করিস না। ভবিতব্যকে মেনে নিতে হয় বোন। দাদা, মার আত্মা যাতে শান্তি পায় সে ব্যবস্থা করতে হবে তো।
– ছোড়দা, অসময়ে মার মৃত্যু? দাদার মৃত্যুও স্বাভাবিক কেন হল না বলতো?
দাদা খাট থেকে পড়ে গেল। মা হার্ট ফেল করলো কেন? কেন? আমাদের মা তো সুস্থ ছিল। শতায়ু নিয়ে মা জন্মেছিল। তবে সব ভুল ছিল ঠিকুজি কুষ্টি।
– এসব ভাবিস না এখন। চল বাড়ি চল।
বিজয়, সুলতা মা দাদার চিতাভস্ম নিয়ে বাড়ি ফিরে গেল।
আলিশান বাড়ি খাঁ খাঁ করছে। সারা বাড়ি জুড়ে “সম্পত্তি চাই সম্পত্তি চাই” প্রতিধ্বনিতে দেওয়াল ফাটল ধরছে। সুলতা দু’হাত দিয়ে কান চেপে বলছে আমি এখানে থাকতে পারব না। আমি পারব না, কিছুতেই না।
বিজয় সুলতাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো, চল তোকে তোর শ্বশুর বাড়িতে নিয়ে যাই।
তুই এখানে থাকলে গুমরে মরবি।
এক বছর পূর্ণ হল আজ 14ই অগস্ট বিজয়ের মা দাদার মৃত্যু বার্ষিকী। পুরোহিত সময় মতো শ্রাদ্ধ শান্তির কাজ শুরু করেছে। সুলতা সময় মতো চলে এসেছে। আত্মীয় পরিজন সবাই এসেছে। কিন্তু সুলতার চোখ আটকে আছে ঐ মেয়েটির দিকে। কে মেয়েটি? সব চেনা পরিচিতির মধ্যে ঐ মেয়েটি অচেনা।
মেয়েটির ওপর নজর রাখছে সুলতা। কুনাল বারবার মেয়েটার কাছে যাচ্ছে দেখে সুলতার সন্দেহ হল, ব্যাপারটা কি জানার জন্য কুনালকে জিজ্ঞাসা করলো, কে এই মেয়েটা?আগে তো দেখিনি ।
কুনাল বলল, এ আমার বোন হৈমন্তী। তুমি ওকে দেখে ছিলে দিদি একবার, তোমার হয়তো মনে নেই।
– ও হৈমন্তী। যখন ক্লাস ফাইভে পড়তো, তখন দেখেছিলাম। কতো পাল্টে গেছে ।খুব সুন্দর দেখতে হৈমন্তীকে।
সুলতা এবার ওর মার ঘরটা দেখার জন্য দোতলার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে যাবে তখন বিজয় মানে ওর ছোড়দার ঘর থেকে চাপা কান্নার শব্দ শুনতে পেয়ে সুলতা থেমে গিয়ে কান পেতে রাখল দরজায় ।
কুনাল কি সব বলছে ছোড়দাকে? কি ফাঁস করে দেবে ? হৈমন্তীকে বিয়ে করতে বাধ্য কেন হবে ছোড়দা? কোথায় ছোড়দা আর কোথায় হৈমন্তী। কি সট্যাটাস আছে ওর আমার বাড়ির বৌ হবে, হুম..রূপ আছে। তো কি হয়েছে!
ছোড়দা,, ছোড়দা কুনাল কি বলছে এ সব সুলতার কথা শুনে কুনাল হন্তদন্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বিজয়ও ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
সুলতা একরাশ চিন্তা নিয়ে মার ঘরে গেল।মার গল্পের বইয়ের পৃষ্ঠা মোড়ানো, যেমনটা আগে ছিল। একই রকম সব, বইয়ের তাকগুলো ভালো করে গুছিয়ে রাখলো সুলতা। এক বছর পর এলো ও মায়ের বাড়িতে। ছোড়দাও এখানে থাকে না। কার কাছে এসে থাকবে। নানা কথা ভাবতে ভাবতে সুলতার আলমারিটার দিকে নজর পড়লো। মার শাড়ি গয়না সব আছে এতে।মার ছোঁওয়া পাবে আবার নতুন করে। এই ভেবে মায়ের আলমারিটা খুললো সুলতা।আলমারিতে সুন্দর করে মার শাড়িগুলো ভাঁজ করা আছে। সুলতা মায়ের ঘরে সব কিছু দেখে নিচে নেমে ছোড়দার ঘরে গেল।ঘরে ছোড়দা নেই। ছোড়দার ঘরে সোফার ওপর কিছুক্ষণ সুলতা বসলো। সোফার ওপর একটা ক্লিনিকের খাম দেখে সুলতা কৌতহল বশতঃ খামটা খুললো। হৈমন্তীর রিপোর্ট দেখে ও চমকে উঠলো, হৈমন্তীর রিপোর্টে ও প্রেগনেন্ট। এর জন্যই তখন কাঁদছিল। তবে কি ছোড়দা! না না ও এমন ছেলেই না। জানতেই হবে কি ঘটতে চলেছে আমাদের বাড়িতে।
সন্ধ্যাবেলায় ছোড়দাকে বলে সুলতা শ্বশুর বাড়ি চলে গেল।
সুলতার গাড়ি ছাড়ার হর্ন শুনতে পেয়েই কুনাল, হৈমন্তী, বিজয় দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। তারপর শুরু হল ওদের কথোপোকথন:
হৈমন্তী বলছে, বিজয় তুমি আমাকে বিয়ে না করলে সুলতা দিদিকে সব বলে দেব। তোমার দাদা তোমার মার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে মারা গেছে। আর তোমার মা তোমার দাদার মৃত্যুর খবর শুনে হার্ট ফেল করেছে। তুমিই আমার দাদাকে তোমার মা মারা গেছে এই মিথ্যে কথা বলতে বলেছো তোমার দাদাকে। আমার দাদা আমার সুখের জন্য এই কাজ করেছে। তুমি আমাকে বিয়ে করবে। আমি এ বাড়ির বৌ হবো। সুলতা দিদি জানে না যে তুমি জঘন্য মনের মানুষ। লোভী চতুর।অমানুষ তুমি, তোমার দাদাকে ট্রাক ধাক্কা মেরেছিল কার কথায় সেটাও বলবো।
– কুনাল হৈমন্তীকে চুপ করতে বল। শেষ করে দেবো কিন্তু ওকে।
– বিজয় আমার বোনকে বিয়ে কর। ও তোর সন্তানের মা হতে চলেছে। দু’দিন পর লোক জানাজানি হবে। তোর পায়ে পড়ি বিজয়।
– তোকে ড্রাইভারের চাকরিটা আমি দিয়ে ছিলাম। সেই বিনিময়ে তুই আমার কথা মতো কাজ করেছিস। ব্যাস হয়ে গেল। আর রইলো হৈমন্তী, ও অনেক খদ্দের পেয়ে যাবে। কিছু টাকা না হয় দিয়ে দেবো।
– চুপ কর বিজয়। হৈমন্তীকে তুই বিয়ে না করলে তোকে আমি শেষ করে দেবো। তোর বাবার সম্পত্তি তোকে ভোগ করতে দেবো না। খুনি.. দু’টো খুন করেছিস তুই। বিজয় কুনালের মধ্যে হাতাহাতি শুরু হয়ে গেল।ভাগ্যিস সুলতা খালি গাড়ি ড্রাইভারকে নিয়ে যেতে বলেছিল তাই তো দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে আসল সত্যিটা জানলো। বড়দা মা কেউ স্বাভাবিক ভাবে মরেনি। অকালে চলে গেল। ছোড়দা তো বড়দার থেকে শতগুণ খারাপ। থানায় ফোন করে সুলতা সব বললো।
পুলিশকে দেখে বিজয় চমকে গেল। আরো চমকে গেল সুলতাকে দেখে।
– তুই শ্বশুর বাড়ি যাস নি? গাড়ি যে বের হলো তবে..
সুলতা বললো, ঠিক বলেছিস খালি গাড়ি ড্রাইভার নিয়ে গেছে। সন্দেহ আমার হয়ে ছিল হৈমন্তী যখন তোর ঘরে কাঁদছিল। কুনাল আর তোর ফিসফিস কথা বলা সেটাও আমাকে অবাক করেছিল। মা বড়দার মৃত্যুর পর তুই বলেছিলিস আমাকে কুনাল ছেলেটা ভালো না। ওকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করবি এককালীন কিছু টাকা দিয়ে। আজ বুঝলাম কুনাল যদি বেগড়বাই করে তবে তুই ফাঁসবি। এতো লোভ তোর!
পুলিশ অফিসার নিয়ে যান বিজয় রায়কে।আমার মা বড়দার আত্মা যেন শান্তি পায় সেটাই দেখবেন। ফাঁসি হলেও আপত্তি নেই।আমি চাই খুনি চরম সাজা পাক। আমার বাবার সব স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি যাতে রামকৃষ্ণ মিশনে দান করা যায় সেই ব্যবস্থা করবেন।
আমার বাবা মার আত্মা শান্তি পাবে।বিজয়কে পুলিশ ভ্যানে করে নিয়ে গেল।সুলতা বারান্দায় দাঁড়িয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে বললো, টাকা জমি বাড়ি গাড়ি সব কেড়ে নিল আমার। সব..
সমাপ্ত
খুব ভালো লাগল। কিন্তু সুলতা ….বলল …আমার সব কেড়ে নিল—এটা কেন বলল , বুঝলাম না! সম্পত্তির ওপর তার তো কোন লোভ ছিল না?
শেষ পর্যন্ত কি দাঁড়ালো ? ঞ্ছদ্যএকজন ছেলে বা মেয়ে কেউই স্বার্থ বা লোভ হীন নয় । তাইতো ? বেশি সম্পত্তি হলে এরকম হতে পারে । তবে গোয়েন্দা গল্প বা পুলিশের ডায়েরি ছাড়া এতটা শোনা যায় না ।
ভালো লেখা । ভালো লাগলো ।
চিত্রটা বিস্তৃত কিন্তু গল্পের বিস্তৃতি পেলাম না ।